পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ১ম অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন

পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ১ম অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন: ভারতবর্ষের ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্যের ইতিহাস যুগে যুগে বিদেশি বণিক ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা- গামা ১৪৯৮ সালে ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করলে এ উপমহাদেশে আসার জন্য ইউরোপীয়দের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের আগমন, বসতি স্থাপন এবং শাসন প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে।

এ অধ্যায়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গ, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইন, ১৯১৯, ১৯৩৫ ও ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৩৭ ও ১৯৪৬ সালের নির্বাচন, দ্বি-জাতি তত্ত্ব, লাহোর প্রস্তাব ও স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।


পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ১ম অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন

১. বঙ্গভঙ্গ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলা প্রেসিডেন্সিকে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয় যা ইতিহাসে ‘বঙ্গবভঙ্গ’ নামে পরিচিত। প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন বিশাল ভূখণ্ডের বাংলা প্রেসিডেন্সিকে দুই ভাগে ভাগ করেন।

বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে তিনি পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। ঢাকা হয় এ প্রদেশের রাজধানী। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাকে একত্রিত করে বাংলা প্রদেশ গঠন করেন।

২. দ্বিজাতিতত্ত্ব বলতে কী বোঝায়? অথবা, দ্বিজাতিতত্ত্ব কী?

উত্তর: হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি, এই ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করার নির্ণায়ক ও আদর্শাশ্রয়ী একটি রাজনৈতিক মতবাদ হলো দ্বিজাতিতত্ত্ব। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্ব উপস্থাপন করেন।

তার মতে, হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি, জীবন পরিচালনা, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতির ক্ষেত্রে দুটি পৃথক অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে। তাই জাতীয়তার মানদণ্ডে হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি। তাই তাদের জন্য প্রয়োজন পৃথক আবাসভূমি বা রাষ্ট্র। মোহাম্ম আলী জিন্নাহর এ মতবাদটিই দ্বিজাতিতত্ত্ব নামে পরিচিত।

৩. মুসলিম লীগ কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল?

উত্তর: তৎকালীন ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও অল্পকালের মধ্যে তা সাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয় এবং কেবল হিন্দুদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

যার ফলে ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ায় তারা একটি স্বতন্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে। এক পর্যায়ে ১৯০৬ সালে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ’র উদ্যোগে কতিপয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়।

৪. কেন ব্রিটিশ সরকার ভাগ কর ও শাসন কর নীতি গ্রহণ করেছিল?

উত্তর: ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে তাদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতেই ভাগ কর ও শাসন কর নীতি গ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পর কূটকৌশল ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ছাড়াও সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। ফলে ব্রিটিশরা এ আন্দোলন-সংগ্রামকে নস্যাৎ করে তাদের দখলদারিত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে ভাগ কর ও শাসন কর নীতি গ্রহণ করেছিল। এ নীতির আওতায় তারা ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ অর্থাৎ বাংলাকে বিভক্ত করার মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভেঙে দিয়ে শাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

৫. ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত ভারতীয় প্রাদেশিক শাসন কীরূপ ছিল?

উত্তর: ১৯৩৫ সালে প্রবর্তিত ভারত শাসন আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। এ আইনে উল্লেখ করা হয় যে, দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রসংক্রান্ত এবং অর্থ এ ত্রিবিধ বিষয়ের কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিচার, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা ‘ইত্যাদি বিষয়ের কর্তৃত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

এক্ষেত্রে আরও উল্লেখ করা হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। এ ব্যবস্থায় মূলত দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে ১৯৩৫ সালের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সফল হয়নি।

৬. লাহোর প্রস্তাব বলতে কী বোঝ?

উত্তর: ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলার কৃতিসন্তান শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক যে প্রস্তাব পাঠ করেন সেই প্রস্তাবই লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। লাহোর, প্রস্তাবে বলা হয়, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

প্রয়োজনমতো সীমা পরিবর্তন করে যেসব স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।

৭. বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: বাংলার হিন্দু মুসলিম সমস্যা দূর করার জন্য স্বরাজ দলের দূরদর্শী, বাস্তববাদী নেতা চিত্তরঞ্জন দাস যে চুক্তি সম্পাদন করেন ইতিহাসে তা বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি নামে খ্যাত। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, স্যার আব্দুর রহিম, স্যার আব্দুল করিম, মাওলানা আকরম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী প্রমুখ নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার পর ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট বা বাংলা চুক্তি সম্পাদিত হয়।

এ চুক্তির ফলে হিন্দু- মুসলমান সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। মুসলমান জনগণের চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি সহজ হয়। কিন্তু এ চুক্তিটি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে থাকে।

৮. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে কী বোঝ?

উত্তর: প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বলতে প্রদেশের প্রাদেশিক সরকারের শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায়। ৫১ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত এবং অর্থ এ ত্রিবিধ বিষয়ের কর্তৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিচার, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ের কর্তৃত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে এভাবেই ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়। মূলত এটিই হলো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন

৯. দ্বৈতশাসন বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: দ্বৈতশাসন বলতে একই প্রশাসনের দুইধরনের কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিকে বোঝায়। ১৯১৯ সালে ভারত শাসনে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশগুলোতে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করা হয়। এরপর দ্বৈতশাসন ব্যবস্থায় প্রাদেশিক বিষয়সমূহকে সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এ দুভাগে বিভক্ত করে তা পরিচালনার জন্য দুধরনের কর্তৃপক্ষের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ফলে বিচার বিভাগ, ভূমি রাজস্ব, পুলিশ, জেল, খনি, সেচ, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা, বনজ শিল্প, খাল খনন ও বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি সংরক্ষিত বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব গভর্নর ও তাঁর কার্যনির্বাহী পরিষদের ওপর ন্যস্ত হয়।

অন্যদিকে কৃষি, শিক্ষা, সমবায়, মৎস্য, স্থানীয় কারবার প্রভৃতি হস্তান্তরিত বিষয়গুলো পরিচালনার জন্য প্রাদেশিক গভর্নর ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তবে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ পরিচালনায় গভর্নর মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন।

১০. মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি কেন গঠিত হয়েছিল?

উত্তর: মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি গঠিত হয়েছিল ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করে গড়ে তোলার জন্য। মুসলিম লীগ গঠনের পেছনে যেসব উদ্দেশ্য ছিল তার মধ্যে অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য বৃদ্ধি করা এবং সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান করা।

এছাড়া মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি ও আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।

১১. স্বদেশি আন্দোলন বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের উগ্রপন্থি অংশের নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকে স্বদেশি আন্দোলন বলা হয়। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ যুক্ত হতে থাকে। আন্দোলনের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য বাংলার জেলায় জেলায় বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এ আন্দোলনের মূল কর্মসূচি ছিল দুটি-বয়কট ও স্বদেশি। তাই স্বদেশি আন্দোলন ব্রিটিশ দ্রব্য বর্জন, বিদেশি রীতিনীতি পরিহার এবং স্বদেশি পণ্য ব্যবহার করে দেশীয় সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হতে জনগণকে আহ্বান করে।

১২. বঙ্গভঙ্গের যেকোনো একটি কারণ ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পেছনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে ‘প্রশাসনিক’ কারণ অন্যতম। বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বাংলার আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮০ লক্ষ। এত বড় প্রদেশ কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য ছিল।

১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষ হলে প্রদেশের বিশালায়তনের কারণে ত্রাণকার্য পরিচালনা ব্যাহত হয়। এছাড়া প্রদেশে প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক কর্মচারী ছিল। যার ফলশ্রুতিতে প্রদেশ বিভাগ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন।

১৩. ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতি বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’ বলতে মূলত ব্রিটিশ সরকারের ভারতবর্ষের মুসলিম-হিন্দু দুটি বৃহৎ সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে শাসন করার কূটকৌশলকেই বোঝায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনকে অপরিহার্য করে তোলা এবং কায়েম রাখার জন্য ব্রিটিশ বেনিয়া ও রাজশক্তির একটি অন্যতম অপকৌশল বা কূটকৌশল হলো ভাগকর শাসন কর নীতি। ব্রিটিশ সরকারের সময়ে লর্ড কার্জন বাংলায় রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরা ক্রমশ। জাতীয়তাবাদ ও রাজনীতি-সচেতন হয়ে উঠছে।

তাই বাংলার একতা বিনষ্ট করে শাসনকার্যে সফলতা আনার লক্ষ্যে তিনি ভাগ কর ও শাসন কর নীতি প্রয়োগ করে। এ নীতির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে এদের সম্ভাব ও সম্প্রীতি নষ্ট করে বিরোধ স্থায়ী করা, এদেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি এবং অঞ্চলভেদে বিভেদ সৃষ্টি করা এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে পণ্ড করা।

১৪. ফরায়েজি আন্দোলন বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ হলো উনিশ শতকে হাজী শরিয়তউল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন। ‘ফরজ’ শব্দটি থেকে ফরায়েজি শব্দটি এসেছে। ‘ফরজ’ শব্দের অর্থ অবশ্য পালনীয়। হাজী শরীয়তউল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো দূর করে মুসলমানদের ধর্মের জ্ঞানে উৎসাহী করা এবং তাদেরকে উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলা।

এজন্য তিনি সকল প্রকার অনৈতিক ও অনৈসলামিক কাজ থেকে বিরত থেকে শুধু ইসলামে যে কাজগুলো ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয় তা করার আদেশ দেন। তবে তার আন্দোলনের মধ্যে ‘ফরজ’ বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিধায় এই আন্দোলনের নাম হয় ফরায়েজি আন্দোলন।

১৫. সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণটি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হলো এনফিল্ড নামক রাইফেলের কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো ছিল বলে প্রচারণা ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড রাইফেল নামে এক প্রকার নতুন বন্দুক চালু করে। এই বন্দুকের কার্তুজ ছিল চর্বিযুক্ত এবং সেই চর্বি গরু ও শূকরের চর্বি বলে প্রচার করা হয়েছিল।

গরুর মাংস বা চর্বি হিন্দুদের নিকট এবং শূকরের মাংস বা চর্বি মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। এ কারণে ঐ কার্তুজ ব্যবহার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিকট ধর্ম নাশ বলে বিবেচিত হয়। ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

১৬. লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা কী ছিল?

উত্তর: লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা ছিল ভারতবর্ষের মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলোর সমন্বয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ভারতীয় উপমহাদেশে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুমোদন করে।

এ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী কাছাকাছি স্থানগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, যাতে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা যায়। মূলত লাহোর প্রস্তাবের মূলভিত্তিই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। তাই এ তত্ত্বের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।

১৭. ১৮৬১ সালের ভারতীয় পরিষদ আইনের একটি ধারা ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ১৮৬১ সালের ভারতীয় পরিষদ আইনের বিভিন্ন ধারার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো পোর্টফোলিও পদ্ধতি। ভারতীয় পরিষদ আইনে শাসন কাজের সুবিধার জন্য ‘পোর্টফোলিও পদ্ধতি’ প্রবর্তন করা হয়। এর ফলে শাসন বা নির্বাহী পরিষদের সদস্যগণের কেউ শাসন, কেউ অর্থ, কেউ আইন বা কেউ সামাজিক দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এর ফলে ভবিষ্যতে ক্যাবিনেট ব্যবস্থা উদ্ভবের পথ প্রশস্ত হয়।

১৮ . লাহোর প্রস্তাবের যেকোনো একটি বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: লাহোর প্রস্তাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এ প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করা হয়।

১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। তাই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯. বঙ্গভঙ্গ রদের কারণগুলো কী ছিল?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ রদের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বিলাতি পণ্য বর্জন বা বয়কট আন্দোলন। গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ এর সুপারিশক্রমে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি দিল্লিতে আগমন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা দেন।

বঙ্গভঙ্গ রদের পিছনে বহুমুখী ঘটনাপ্রবাহ ও কারণ বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো কংগ্রেস ও হিন্দুদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বিলাতি পণ্য বর্জন বা বয়কট আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, স্বরাজ আন্দোলন, মুসলমানদের দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি, ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন, ব্রিটিশ সরকারের হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের বিরোধিতা ইত্যাদি।

২০. লাহোর প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে অভিহিত করা হয় কেন?

উত্তর: লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয় বিধায় লাহোর প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা ছিল ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া। পরবর্তীতে একাধিক রাষ্ট্রের স্থলে একক রাষ্ট্র ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তাই লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাবও বলা হয়।

২১. সূর্যাস্ত আইন বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: সূর্যাস্ত আইন বলতে ব্রিটিশ ভারতের জমিদারগণকে মাসের কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বেই খাজনা প্রদানের কঠো আইনকে বোঝায়। লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলায় সূর্যাস্ত আইন জারি করেন। লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর নিয়মিত খাজনা আদায়ের জন্য অন্যান্য আইনের পাশাপাশি ‘সূর্যাস্ত আইন’ বলবৎ করেন। মূলত কোম্পানির রাজস্ব একটি নির্দিষ্ট দিনে জমিদাররা সূর্যাস্তের পূর্বে দিতে অসমর্থ হলে কোম্পানি তাদের জমিদারি নিলামে বিক্রি করত। আর এটিই সূর্যাস্ত আইন বলে পরিচিত ছিল।

২২. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: নির্দিষ্ট রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারগণকে নিজ নিজ জমির উপর স্থায়ী মালিকানা দান করে কোম্পানি যে বন্দোবস্ত চালু করে তাকে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বলে। কোম্পানির শাসন দুর্নীতিমুক্ত ও সুসংগঠিত করতে ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসকে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও সেনা প্রধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

২৩. ‘সাইমন কমিশন’ কী? ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ‘ভারত শাসন আইনের’ কার্যকারিতা পর্যালোচনা এবং ভারতের জন্য ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে সুপারিশ পেশের জন্য যে কমিশন গঠন করা হয় তাকে সাইমন কমিশন বলা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতীয় জনগণের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূরণ হয়নি। ফলে এই আইন ভারতবাসীদের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। ভারতবাসীরা এই আইনের তুমুল বিরোধিতা শুরু করে।

ভারত শাসন আইন পুনর্বিবেচনা করে ভারতীয় জনগণের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়া পরীক্ষা করে দেখার জন্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের সভাপতি স্যার জন সাইমনের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘সাইমন কমিশন’।


আরও দেখুন: পৌরনীতি ও সুশাসন সকল অধ্যায় সমাধান

আশাকরি “পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ১ম অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের কোন আপডেট মিস না করতে ফলো করতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেজ ও সাবক্রাইব করতে পারেন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।

Leave a Comment