পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ৩য় অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন: বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। এ ইতিহাস অন্যায়, শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাস। এ ইতিহাস বাঙালির হাসি-কান্না ও দুঃখ-বেদনার ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে ঠাঁই করে নিয়েছে। সমাজ রাজনীতির অগ্রগতিতে নেতৃত্বের ভূমিকা সর্বস্বীকৃত।
অন্যদিকে নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা এর গতিধারাকে রুদ্ধ করে কিংবা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারে। ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তির জীবন, কর্ম এবং সমাজ ও রাজনীতিতে তাঁদের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে এ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচিত ব্যক্তিরা হলেন: হাজী শরিয়তুল্লাহ, তিতুমীর, নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ৩য় অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন
১. বেঙ্গল প্যাক্ট কাকে বলে?
উত্তর: বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করার লক্ষ্যে ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নিজ উদ্যোগে উভয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের নিমিত্তে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকে বেঙ্গল প্যাক্ট বলে। বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনের ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন দাসের নাম অবিস্মরণীয়। দূরদর্শী ও বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাস বুঝতে পেরেছিলেন মুসলমানদের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়।
তাই তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনে একটি চুক্তির কথা চিন্তা করেন। তার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলার মুসলিম নেতা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আরও কিছু নেতা এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সুদীর্ঘ আলোচনার পর ১৯২৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বরাজ পার্টির এক সভায় বেঙ্গল প্যাক্ট অনুমোদন লাভ করে।
২. ফরায়েজি আন্দোলন বলতে কী বোঝ?
উত্তর: ফরায়েজি আন্দোলন হচ্ছে উনিশ শতকে হাজী শরিয়তউল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্ম সংস্কারমূলক আন্দোলন। ফরায়েজি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। ফরজ শব্দটি থেকে ‘ফরায়েজি’ শব্দটি এসেছে। ‘ফরজ’ শব্দের অর্থ হলো অবশ্য পালনীয়। হাজী শরীয়তউল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো দূর করে মুসলমানদের ধর্মের জ্ঞানে উৎসাহী করা এবং তাদেরকে উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলা।
এজন্য তিনি সকল প্রকার অনৈতিক’ ও অনৈসলামিক কাজ থেকে বিরত থেকে শুধু ইসলামে যে কাজগুলো ‘ফরজ’ বা অবশ্য পালনীয় তা করার আদেশ দেন। তবে তার আন্দোলনের মধ্যে ‘ফরজ’ বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিধায় এই আন্দোলনের নাম হয় ফরায়েজি আন্দোলন।
৩. তিতুমীর কেন বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেন?
উত্তর: ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে তিতুমীর ‘বাঁশের কেল্লা’ নির্মাণ করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতার নিকটবর্তী নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে তিতুমীর একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন, যা বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। ইতিহাসে এ কেল্লাই নারিকেল বাড়িয়ার বাঁশের কেল্লা নামে পরিচিত।
এ কেল্লাই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। হাজার হাজার লোককে তিতুমীর এখানে এনে সাময়িক কায়দায় প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। সবশেষে এ বাঁশের কেল্লা থেকেই তিতুমীর জমিদারদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকারের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
৪. ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ কেন গঠন করা হয়েছিল?
উত্তর: সুদখোর মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য কৃষক দরদি নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠন করেন। ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কৃষকদের ঋণভার লাঘবের জন্য ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠন করেন। ফলে কৃষকরা নানাভাবে উপকৃত হতে থাকে। অবশ্য ১৯৩৮ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব’ আইন পাশ হওয়ার ফলে জমির উপর কৃষকদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ আইনের ফলেই জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে।
৫. লাহোর প্রস্তাব বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি সংবলিত যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তাই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। ভারতীয় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য ‘একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র’ গঠনের কথা বলেন। উক্ত প্রস্তাবের মাধ্যমেই তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধিকার অর্জনের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে এই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে মজলুম জননেতা বলা হয় কেন?
উত্তর: শোষিত ও নিপীড়িত মানুষদের স্বার্থ নিয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন বিধায় তাকে মজলুম জননেতা বলা হয়। ষাটের দশকে আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলনে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন এক জ্বালাময়ী কণ্ঠ। তিনি সবসময় সাম্যের কথা বলেছেন। কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি ও জনঅধিকার প্রতিষ্ঠায় মাওলানা ভাসানী এক বলিষ্ঠ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার সুযোগ্য নেতৃত্বের কথা সর্বজনবিদিত। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনীতিতে তিনি একটি স্বতন্ত্র ধারা তথা জনগণভিত্তিক রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
৭. নবাব আব্দুল লতিফকে বাংলার সৈয়দ আহমদ বলা হয় কেন?
উত্তর: সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারে উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহমেদের মতো নবাব আব্দুল লতিফের বিশেষ অবদান ছিল বলেই তাঁকে ‘বাংলার সৈয়দ আহমেদ’ বলা হয়। শিক্ষা বিস্তারে নবাব আব্দুল লতিফের অবদান ছিল অসামান্য। তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষা ব্যতীত এ ভূখণ্ডের মুসলমান সম্প্রদায়ের মুক্তির কোনো বিকল্প পথ নেই। তাই তাদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য ১৮৬৩ সালে তাঁর একক প্রচেষ্টায় ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ বা মুসলমান সাহিত্য সমিতি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।
তাছাড়া তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৭৩ সালে ‘কলকাতা হিন্দু কলেজ’ প্রেসিডেন্ট কলেজে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার পথ প্রশস্ত হয়। তিনি নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তিনি মহসিন ফান্ড পুনর্গঠন করেন। এসব অবদানের কারণেই তাকে বাংলার সৈয়দ আহমেদ বলা হয়।
৮. স্বরাজ দল গঠন করা হয়েছিল কেন?
উত্তর: স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বরাজ দল গঠন করা হয়েছিল। গান্ধীজি গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেক নেতার ওপর কংগ্রেসের কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে। আর এই কর্মসূচি নির্ধারণ করা নিয়েই কংগ্রেসের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে চিত্তরঞ্জন দাশের মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯২২ সালে তিনি সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর ১৯২৩ সালে নির্বাচনের পূর্বেই তিনি এলাহাবাদে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। এর মূল লক্ষ্য স্বরাজ (স্বায়ত্তশাসন) অর্জন।
৯. ‘মুজিবনগর সরকারের’ গঠন ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠন করা হয়। মুজিবনগর সরকারে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন তিনি পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তাছাড়া তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র দফতর, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলীকে অর্থ দফতর, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধান সেনাপতি করা হয় কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীকে এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন করা হয় এ কে খন্দকারকে।
আরও দেখুন: পৌরনীতি ও সুশাসন সকল অধ্যায় সমাধান
আশাকরি “পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র ৩য় অধ্যায় অনুধাবন প্রশ্ন” আর্টিকেল টি আপনাদের ভালো লেগেছে। আমাদের কোন আপডেট মিস না করতে ফলো করতে পারেন আমাদের ফেসবুক পেজ ও সাবক্রাইব করতে পারেন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল।